যশোর: বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমণ পরিক্রমা
যশোর, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা এবং ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রকৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে ভ্রমণকারীদের জন্য বহু আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে। যশোর জেলা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য একটি অন্যতম জনপ্রিয় গন্তব্য। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। আসুন এই জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান এবং ভ্রমণের জন্য আদর্শ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করি।
যশোর জেলা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
যশোর জেলা, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীন শহর যার ইতিহাস সমৃদ্ধ এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। যশোর শহরটি খুলনা বিভাগে অন্তর্ভুক্ত এবং চট্টগ্রাম, খুলনা এবং ঢাকা থেকে সড়কপথে সহজেই প্রবেশ করা যায়। এই জেলার মধ্যে অনেক প্রাচীন স্থাপত্য, প্রকৃতি, ঐতিহাসিক স্থান এবং সাংস্কৃতিক উৎসব রয়েছে যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
যশোর জেলার দর্শনীয় স্থানসমূহ
১.গদখালী ফুলের বাগান, যশোর: প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য
বাগানের ইতিহাস ও গুরুত্ব
গদখালী ফুলের বাগানটি গড়ে ওঠে কয়েক দশক আগে, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগে। এটি একটি সুন্দর প্রাকৃতিক স্থান তৈরির লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাগানের শুরুর দিকে স্থানীয় জনগণ এবং পরবর্তীতে পর্যটকদের জন্য একটি বিশ্রামস্থান হিসেবে এটি গড়ে উঠে। এখানে ফটোগ্রাফি, পিকনিক এবং নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য পর্যটকদের আগমন বেড়ে যায়। বাগানটির দেখাশোনা, পরিচর্যা এবং নতুন ফুলের জাত উৎপাদনে স্থানীয় কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাগানে কী কী করবেন
গদখালী ফুলের বাগানে ভ্রমণকারীরা বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। বাগানের প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি এখানে ঘোরাঘুরি করতে পারেন, ফুল সংগ্রহ করতে পারেন এবং বিশেষ করে শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও আনন্দময় স্থান এটি। এছাড়াও, এখানে এসে ভ্রমণকারীরা পিকনিকের ব্যবস্থা করতে পারেন, যা পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আনন্দময় সময় কাটানোর একটি উপযুক্ত মাধ্যম।
কিভাবে যাবেন গদখালী ফুলের বাগান, যশোর?
যশোর জেলার গদখালী ফুলের বাগান প্রকৃতির প্রেমীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। এই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য সহজ ও উপযোগী কিছু পথ রয়েছে। নিচে সেগুলোর বিস্তারিত দেওয়া হল:
# # ট্রেন বা বাসে যাওয়া:
- যশোর শহর থেকে গদখালী ফুলের বাগানে যাওয়া খুবই সহজ। আপনি প্রথমে যশোর রেলওয়ে স্টেশন অথবা বাস টার্মিনালে পৌঁছাবেন।
- ট্রেনে যাওয়া: ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ইত্যাদি থেকে সরাসরি যশোর রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন চলাচল করে। সেখানে পৌঁছে রিকশা অথবা টেম্পু ভাড়া করে বাগানে যেতে পারবেন।
- বাসে যাওয়া: ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাট, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ইত্যাদি জায়গা থেকে বাসে করে যশোর শহরে পৌঁছাবেন। এরপর স্থানীয় বাস অথবা রিকশা নিয়ে গদখালী ফুলের বাগান এর দিকে যেতে হবে।
# # গাড়ি ভাড়া করা:
- যশোর শহরের যেকোনো স্থান থেকে অটো রিকশা, মোটর সাইকেল, অথবা টেম্পু ভাড়া করে গদখালী ফুলের বাগান পর্যন্ত যাওয়া যায়।
- যদি আপনি ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যেতে চান, তাহলে যশোর শহর থেকে গদখালী ফুলের বাগানের দূরত্ব মাত্র ১০ কিলোমিটার। সহজেই পৌঁছানো যাবে। রাস্তাগুলো বেশ ভালো এবং গাড়িতে চলাচলের জন্য উপযুক্ত।
# # সাইকেল ভ্রমণ:
- সাইকেল ভ্রমণের জন্য গদখালী ফুলের বাগান একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। যদি আপনি সাইকেল ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন, তাহলে যশোর শহর থেকে সাইকেলে করে যেতে পারেন। সাইকেলে করে বাগানে পৌঁছাতে পথে আপনি আশেপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
# # স্থানীয় পরিবহন:
- স্থানীয় বাস, অটো রিকশা, কিংবা মোটর সাইকেল ভাড়া করে যশোর শহর থেকে গদখালী ফুলের বাগান এ পৌঁছানো সম্ভব।
- যশোর শহরের রাস্তাগুলো সাধারণত পরিষ্কার এবং স্থানীয় পরিবহন ভালোভাবে চলাচল করে, তাই আপনার যাত্রা সহজ হবে।
থাকার জায়গা গদখালী ফুলের বাগান, যশোর
গদখালী ফুলের বাগানে ভ্রমণকারী পর্যটকদের থাকার জন্য কিছু সুবিধাজনক আবাসন ব্যবস্থা রয়েছে যেগুলো আপনাকে থাকার সময়টির অভিজ্ঞতা আরও বেশি উপভোগ্য করে তুলবে। নিচে গদখালী ফুলের বাগান এলাকার আশেপাশের কিছু ভাল থাকার জায়গার তথ্য দেওয়া হল:
যশোর শহরে থাকা: যশোর শহরে বিভিন্ন ধরনের হোটেল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কিছু জনপ্রিয় পছন্দের স্থানগুলো হল:
- হোটেল মেরিনো: শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত, যেখানে ভাল মানের পরিষেবা এবং আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
- হোটেল প্লাজা: কম খরচে বাসস্থান খোঁজার জন্য আদর্শ।
- স্থানীয় আবাসন ব্যবস্থা: যশোরের আশেপাশে এবং গদখালী ফুলের বাগান এলাকার কাছে বেশ কিছু ভাল হোটেল রয়েছে ।
- গদখালী ফুলের বাগান এলাকায় গেস্ট হাউজ ও বাংলো: গদখালী ফুলের বাগানের আশেপাশে বেশ কিছু গেস্ট হাউজ রয়েছে, যেখানে আপনি ব্যাক্তিগত এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশে থাকার সুবিধা পাবেন।
বাগানের সৌন্দর্য নিয়ে কিছু পরামর্শ
গদখালী ফুলের বাগান আসলে একটি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের জায়গা। এখানে যেতে হলে আপনার ক্যামেরা, ফুলের বাগানের রঙিন দৃশ্য ধারণ করার জন্য, আর একটি স্পষ্ট মনযোগ দরকার। সকাল অথবা বিকেলের বেলা এখানে গিয়ে আপনি প্রকৃতির রূপের অপূর্ব মেলবন্ধন অনুভব করতে পারবেন। এই সময়টাতে সূর্যের আলো বাগানের রঙিন ফুলগুলোকে আরও চমৎকার করে তোলে।
গদখালী ফুলের বাগান যশোরের অন্যতম সুন্দর স্থান, যা প্রকৃতির প্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ গন্তব্য। এখানে এসে প্রকৃতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা সবার জন্য নিঃসন্দেহে এক অনন্য এবং মনে রাখার মতো মুহূর্ত হবে।
২.বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক: যশোরের বিনোদনের প্রাণকেন্দ্র
যশোর শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে যশোর ক্যান্টনমেন্টের শানতলা এলাকায় অবস্থিত বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক । ১৯৯৮ সালে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফয়েজ আহমেদ এই পার্কটি নির্মাণ করেন। এটি যশোরের অন্যতম আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
পার্কের আকর্ষণ
বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্কে রয়েছে:
- বিভিন্ন আকর্ষণীয় রাইড
- মিনি চিড়িয়াখানা
- শিশু পার্ক
- রবিনহুডের ঘর
- কৃত্রিম ঝর্ণা
- নদী
- কনফারেন্স রুম
- খাবারের সুব্যবস্থা
এছাড়া পার্কে পিকনিক, পুনর্মিলনী, এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও রয়েছে। শুরুতে পার্কটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও বর্তমানে প্রবেশের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সময়সূচি ও প্রবেশ মূল্য
পার্কটি সাপ্তাহিক সাত দিন খোলা থাকে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত দর্শনার্থীরা এখানে ভ্রমণ করতে পারেন।
- প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ মূল্য: ২০ টাকা
- ছোট বাচ্চাদের প্রবেশ মূল্য: ১০ টাকা
- শিশুদের রাইডের টিকিট: ১০-২০ টাকা
স্পট ভাড়া ও অন্যান্য সুবিধা
- রান্নাঘর, পানি, এবং কার্পেট সুবিধাসহ স্পট ভাড়া: ১০০০-৩৫০০ টাকা
- সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন ফি (প্রতি ঘন্টা): ৫০০ টাকা
- পার্কিং ফি:
- বাস: ১০০ টাকা
- মাইক্রোবাস/জীপ: ২০ টাকা
- মোটরবাইক: ১০ টাকা
কীভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে প্রথমে যশোর শহরে আসতে হবে। এরপর রিকশা বা ইজিবাইক ব্যবহার করে পালবাড়ী মোড়ে যেতে হবে। পালবাড়ী মোড় থেকে ইজিবাইকে সরাসরি বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্কে যাওয়া সম্ভব।
থাকার ব্যবস্থা
যশোরে থাকার জন্য বেশ কিছু সরকারি রেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেল রয়েছে। উল্লেখযোগ্য হোটেলগুলো হলো:
- হাসান
- মনিহার
- মিডটাউন
- মিডওয়ে
- নয়ন
- চৌধুরী
- গ্র্যান্ড হোটেল
- ম্যাগপাই
খাবারের ব্যবস্থা
যশোরের বিখ্যাত খাবারগুলো হলো:
- জামতলার মিষ্টি
- খেজুরের গুড়ের প্যারা সন্দেশ
- ভিজা পিঠা
- ধর্মতলার মালাই চা
- চুকনগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
যশোর ভ্রমণে বিনোদিয়া ফ্যামিলি পার্ক একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা এনে দেবে। পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে একটি সুন্দর দিন কাটানোর জন্য এই পার্কে ভ্রমণ অবশ্যই উপভোগ্য হবে।
৩.ঝাঁপা বাওড়ের ভাসমান সেতু: মণিরামপুরের এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা
যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার ঝাঁপা বাওড়ের উপর নির্মিত হয়েছে প্রায় ১৩০০ ফুট দীর্ঘ একটি ভাসমান সেতু। এটি দেশের প্রথম ও দীর্ঘতম ভাসমান সেতু হিসেবে স্বীকৃত। ঝাঁপা গ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের চলাচলের সমস্যা সমাধানে এই সেতুটি একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ।
সেতুর নির্মাণ ও উদ্দেশ্য
আগে ঝাঁপা গ্রামবাসীদের কপোতাক্ষ নদ এবং ঝাঁপা বাওড়ের কারণে নৌকা ছাড়া চলাচল করতে হতো। ফলে তাদের প্রায় ১০ কিলোমিটার ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছাতে হতো। এ সমস্যা সমাধানে স্থানীয়রা একত্র হয়ে ‘ঝাঁপা গ্রাম উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ গঠন করেন।
এই ফাউন্ডেশনের সদস্যরা স্বেচ্ছাশ্রম এবং গ্রামবাসীর অর্থ সহায়তায় মাত্র তিন মাসে ১৩০০ ফুট দীর্ঘ ও ৯ ফুট প্রস্থের এই ভাসমান সেতুটি তৈরি করেন। সেতুটি নির্মাণে ৮৩৯টি নীল রঙের ভাসমান ড্রাম এবং স্টিলের পাত ব্যবহার করা হয়েছে। দুইপাশে নিরাপত্তা রেলিংও সংযোজন করা হয়েছে।
আকর্ষণ ও গুরুত্ব
এই সেতুর মাধ্যমে এখন মোটরসাইকেল, ভ্যানগাড়িসহ ছোট যানবাহন চলাচল করতে পারছে। গ্রামবাসীর চলাচলের পাশাপাশি এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ঝাঁপা বাওড়ের সৌন্দর্যের সঙ্গে সেতুটির দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য পর্যটকদের মুগ্ধ করছে।
পর্যটনের নতুন সম্ভাবনা
ভাসমান সেতুকে কেন্দ্র করে ঝাঁপা গ্রামে পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। এখানে ইতোমধ্যেই একটি পিকনিক স্পট তৈরি করা হয়েছে। পূর্বপাড়ে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে মসজিদ ও ঈদগাহ কমিটি। সেতুতে প্রবেশের জন্য ৫ টাকা টিকিটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
কিভাবে যাবেন
ভাসমান সেতু দেখতে চাইলে প্রথমে যশোর শহরে আসতে হবে। এরপর স্থানীয় পরিবহন ব্যবহার করে রাজগঞ্জ বাজারে পৌঁছালেই সেতুটি দেখা যাবে।
যাতায়াত ব্যবস্থা
ঢাকা থেকে বাসে যশোর:
ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলী এবং কলাবাগান থেকে সোহাগ, হানিফ, এম.আর এন্টারপ্রাইজ, গ্রিন লাইন, এবং শ্যামলী পরিবহনের এসি/নন-এসি বাসে যশোর যাওয়া যায়। ভাড়া:
- নন-এসি: ৫৫০-৭৫০ টাকা
- এসি: ৭৫০-১৩০০ টাকা
ঢাকা থেকে ট্রেনে যশোর:
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে আন্তঃনগর ট্রেন যেমন সুন্দরবন এক্সপ্রেস, চিত্রা এক্সপ্রেস এবং বেনাপোল এক্সপ্রেসের যশোরগামী ট্রেনে যাওয়া যায়। টিকিটের মূল্য: ৫৬০-১৯৩৮ টাকা।
কোথায় থাকবেন
যশোর শহরে বেশ কিছু মানসম্মত আবাসিক হোটেল রয়েছে, যেমন:
- হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টারন্যাশনাল
- হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল
- জাবির ইন্টারন্যাশনাল হোটেল
- হোটেল আর.এস ইন্টারন্যাশনাল
- হোটেল শামস ইন্টারন্যাশনাল
কোথায় খাবেন
যশোরের বিখ্যাত খাবারগুলো হলো:
- জামতলার মিষ্টি
- খেজুরের গুড়ের প্যারা সন্দেশ
- ভিজা পিঠা
- ধর্মতলার মালাই চা
- চুকনগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
এছাড়া চার খাম্বার মোড়ের ‘জনি কাবাব’ থেকে কাবাব, ফ্রাই বা লুচি উপভোগ করতে পারেন।
৪.বেনাপোল স্থল বন্দর: বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বের প্রবেশদ্বার
বাংলাদেশের যশোর জেলার শার্শা উপজেলায় অবস্থিত বেনাপোল গ্রামটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকা। এখানেই অবস্থিত দেশের বৃহত্তম ও অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর, বেনাপোল স্থল বন্দর। এটি শুধু একটি সীমান্ত পয়েন্ট নয়; বরং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি প্রাণকেন্দ্র।
Credit By TourtodayBdবেনাপোল স্থল বন্দরের ইতিহাস ও গুরুত্ব
বেনাপোল স্থল বন্দরটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল স্থলবন্দর এর বিপরীতে অবস্থিত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে এই এলাকাটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে এটি দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র।
কলকাতা থেকে মাত্র ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বন্দরটি দুই দেশের বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন করে। প্রতিদিন এই সীমান্ত দিয়ে শত শত পণ্যবাহী ট্রাক এবং যাত্রী চলাচল করে। বাণিজ্যিক কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক এবং সাধারণ মানুষ যাতায়াতের জন্য এই পথ ব্যবহার করেন।
বেনাপোল বন্দরে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ একটি কাস্টম হাউস রয়েছে, যেখানে পণ্য আমদানি-রপ্তানির শুল্ক আদায় করা হয়। এছাড়া এখানে রয়েছে একটি আন্তর্জাতিক মানের পাসপোর্ট অফিস, যা ভ্রমণকারীদের জন্য ভিসা সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সহজ করে তোলে।
বেনাপোল রেল যোগাযোগ
বেনাপোল স্থলবন্দর শুধু সড়কপথে নয়, রেলপথেও যুক্ত। বেনাপোল রেলস্টেশন থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগের সুবিধা রয়েছে। ট্রেনযোগে পণ্য পরিবহন আরও সহজ এবং সাশ্রয়ী হয়েছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা
বেনাপোল স্থল বন্দরে যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে।
১. বাস:
ঢাকার কল্যাণপুর, গাবতলী এবং কলাবাগান থেকে সোহাগ, হানিফ, শ্যামলী, এবং গ্রিন লাইন পরিবহণের এসি ও নন-এসি বাসে যশোর আসা যায়।
- নন-এসি বাস ভাড়া: ৫৫০-৭৫০ টাকা
- এসি বাস ভাড়া: ৭৫০-১,৩০০ টাকা
যশোর শহর থেকে বেনাপোল স্থলবন্দরে যেতে বাস, অটো, বা প্রাইভেট কার ব্যবহার করা যায়।
২. ট্রেন:
ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে সরাসরি ট্রেনযোগে বেনাপোল পৌঁছানো যায়।
- সুন্দরবন এক্সপ্রেস: সকাল ৮:১৫ মিনিটে
- চিত্রা এক্সপ্রেস: সন্ধ্যা ৭:৩০ মিনিটে
- বেনাপোল এক্সপ্রেস: রাত ১১:৪৫ মিনিটে
শ্রেণি ভেদে ট্রেনের ভাড়া ৫৬০-১,৯২৭ টাকা।
৩. বিমান:
ঢাকা থেকে যশোর বিমানবন্দর পর্যন্ত বিমানে যাওয়া যায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ এয়ারলাইনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ বিমান, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স, এবং নভোএয়ার নিয়মিত ফ্লাইট পরিচালনা করে।
আবাসন ব্যবস্থা
যশোর শহরে থাকার জন্য বেশ কয়েকটি মানসম্মত আবাসিক হোটেল রয়েছে।
- হোটেল সিটি প্লাজা ইন্টারন্যাশনাল
- হোটেল হাসান ইন্টারন্যাশনাল
- হোটেল শামস ইন্টারন্যাশনাল
এছাড়া সরকারি রেস্ট হাউস এবং আরও সাধারণ মানের কিছু আবাসিক হোটেলও পাওয়া যায়।
খাবারের বিশেষত্ব
যশোরের বিখ্যাত খাবারগুলো ভ্রমণকে আরও উপভোগ্য করে তোলে।
- জামতলার মিষ্টি
- খেজুরের গুড়ের প্যারা সন্দেশ
- ধর্মতলার মালাই চা
- চুকনগরের বিখ্যাত চুই ঝাল
বেনাপোলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বেনাপোল স্থল বন্দরকে ঘিরে ভবিষ্যতে পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। এখানে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংযোজনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মানের একটি পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
উপসংহার
বেনাপোল স্থল বন্দর শুধু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও ভ্রমণের কেন্দ্র নয়; বরং এটি দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের একটি প্রতীক। বেনাপোলের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক কার্যক্রম এই অঞ্চলকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। যেকোনো পর্যটক বা ব্যবসায়ীর জন্য বেনাপোল একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য।
৫.ভরতের দেউল: এক ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলায় গৌরিঘোনা ইউনিয়নের ভরত ভায়না গ্রামে ভদ্রা নদীর তীরে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপনা ভরতের দেউল। এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই টিলা আকৃতির দেউলের উচ্চতা প্রায় ১২.২০ মিটার এবং পরিধি ২৬৬ মিটার।
ভরতের দেউলের ইতিহাস
ধারণা করা হয়, ভরতের দেউল গুপ্ত যুগে খ্রিস্টীয় ২য় শতকে নির্মিত। এটি প্রাচীনকালে একটি মন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে দেউলটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তীতে, ১৯২৩ সালের ১০ জানুয়ারি, এটিকে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
১৯৮৪ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন দফায় খনন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এতে দেউলের মঞ্চ, মন্দিরের অবকাঠামো, এবং ৯৪টি কক্ষের সন্ধান পাওয়া যায়। এই কক্ষগুলোর মধ্যে ১২টি প্রধান কক্ষ চারপাশে উইং ওয়ালে ঘেরা, এবং বাকি ৮২টি কক্ষ বৌদ্ধ স্তূপাকারে নির্মিত। স্তূপের চূড়ায় থাকা ৪টি কক্ষের দুই পাশে আরও ৮টি ছোট কক্ষ দেখা যায়।
দেউলের নিদর্শন
খননকৃত নিদর্শনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
- পোড়া মাটির নারীর মুখমণ্ডল
- নকশা করা ইট
- মাটির ডাবর
- পোড়া মাটির অলংকার
- দেব-দেবীর টেরাকোটার ভগ্নাংশ
দেউলে ব্যবহৃত টেরাকোটা ও ইট বাংলাদেশের অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার তুলনায় আকারে বৃহৎ। স্থানীয় জনগণের কাছে এই স্থাপনাটি ভরত রাজার দেউল নামে পরিচিত।
কীভাবে যাবেন
যদিও ভরতের দেউল যশোর জেলায় অবস্থিত, তবে খুলনা থেকে সেখানে পৌঁছানো অপেক্ষাকৃত সহজ।
প্রথম পথ:
১. খুলনা থেকে বাস বা ট্রেনে চুকনগর পর্যন্ত যান।
২. চুকনগর থেকে ভ্যান বা মোটরসাইকেলে ভরতের দেউলে পৌঁছানো যাবে।দ্বিতীয় পথ:
১. খুলনা থেকে রিকশা বা অটোতে মহসিন মোড়ে যান।
২. মহসিন মোড় থেকে শাহপুর বাজারে যান।
৩. সেখান থেকে ভ্যানে চড়ে ভরতের দেউল পৌঁছান।
মনে রাখবেন: স্থানীয়রা এটিকে “ভরতের দেল” নামে চেনে।
কোথায় থাকবেন
ভরতের দেউলের আশপাশে রাত্রিযাপনের জন্য কোনো আবাসিক সুবিধা নেই। তাই খুলনা শহরে ফিরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। খুলনায় থাকার জন্য উল্লেখযোগ্য হোটেলগুলো হলো:
- টাইগার গার্ডেন
- হোটেল রয়েল
- ক্যাসল সালাম
- ওয়েস্টার্ন ইন
- হোটেল হলিডে ইন্টারন্যাশনাল
- হোটেল মিলেনিয়াম
কোথায় খাবেন
দেউল দর্শনের পর চুকনগরে বিখ্যাত আব্বাসের হোটেলের খাসির মাংস খেয়ে দেখতে পারেন। এটি স্থানীয়দের কাছে একটি জনপ্রিয় খাবারের স্থান।
কোন মন্তব্য নেই